জয় গোস্বামীর কবিতার সঙ্গে আমার পরিচয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়। আমি যে তখন খুব কবিতা পড়তাম, কিংবা এখনও পড়ি, তেমনটা নয়। কিন্তু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সিনিয়র ছিলেন শ্যামল ভট্টাচার্য। শ্যামলদা নিজে খুব ভালো কবিতা লিখতেন। শ্যামলদাই আমাকে প্রথম জয় গোস্বামীর কবিতা শুনিয়েছিলেন। তারপর ১৯৯৬ নাগাদ জয় গোস্বামীর মালতীবালা বালিক বিদ্যালয়ে সুর দিয়ে বেণীমাধব গাইলেন লোপামুদ্রা। সেই গান শুনে আমি লোপা এবং জয় দুজনেরই ফ্যান হয়ে গেলাম। কিন্তু তখন আমার সঙ্গে জয়দার আলাপ হয়নি। আলাপ হল আরও অনেক পরে। ২০০৬ সালের ২২ অগাস্ট।দীর্ঘ উনিশ বছর পরেও তারিখটি এমন নিখুঁতভাবে মনে থাকল কী করে সেই গল্পই আজ বলব।

তখন আমি স্টার আনন্দে চাকরি করি। জয়দার সেদিন আমাদের অফিসে সকালে আসার কথা। ক্রিকেট নিয়ে একটা শো হবে, সেখানে তিনি কিছু বলবেন। জয় গোস্বামী যে ক্রিকেট সম্পর্কে আগ্রহী এবং নিজে না খেললেও খেলাটি সম্বন্ধে জানেন এটা এতদিনে নিশ্চয় অনেকেই জেনে গেছেন। জয়দা তখন থাকতেন বৈষ্ণবঘাটা পাটুলির কাছে কোনও একটি বাড়িতে। আমার ওপর দায়িত্ব পড়ল, জয়দাকে বাড়ি থেকে তুলে অফিসে নিয়ে আসার কারণ আমিও কাছাকাছিই থাকি। কোনও অসুবিধা নেই। বেশ ঝলমলে রোদালো এক সকালে জয় গোস্বামীকে গাড়িতে তুললাম। সেদিনই প্রথম তাঁর সঙ্গে আলাপ হল এবং কথাবার্তা শুরু হল। কিছুক্ষণ কথা বলার পর জয়দা বললেন,
বুঝলেন দীপান্বিতা আজ না দিনটা খুব ভালো। এই যে দেখুন আপনার সঙ্গে আলাপ হল। তাছাড় আমার মনটা খুব ভালো আছে সকাল থেকেই। কেন জানেন, আজ সন্ধেয় আমি একটা নাটক দেখতে যাব।
আমিও একইসঙ্গে খুশি আর আশ্চর্য হয়ে বললাম,
আমিও আজ খুব খুশি আছি দাদা, কারণ আজ আপনার সঙ্গে প্রথমবার কথা বলব জানতাম। তাছাড়া আমিও আজ একটা নাটক দেখতে যাব।
তাই নাকি ! কী নাটক দেখতে যাবেন আপনি ?

দেখা গেল আমরা দুজনেই সেদিন পঞ্চম বৈদিকের পশুখামার নাটকটি দেখতে যাব। জর্জ অরওয়েলের অ্যানিমাল ফার্ম উপন্যাস অবলম্বনে পশুখামার নাটক মঞ্চস্থ করেছিল পঞ্চম বৈদিক। পরিচালক অর্পিতা ঘোষ। ২০০৬ সালের ২২ অগাস্ট ছিল অ্যাকাডেমিতে তার ফার্স্ট শো। আর সেদিনই আমার আলাপ হয়েছিল জয় গোস্বামীর সঙ্গে। তারিখটা তাই মনে আছে বিশেষভাবে।

গাড়িতে আসতে আসতেই জয়দার সঙ্গে দিব্যি ভাব হয়ে গেল আমার। সেদিন এবং তারপরেও আরও অনেক গল্প হয়েছে, আলোচনা হয়েছে, বিনিময়ও হয়েছে। বিশেষ করে নন্দীগ্রাম আন্দোলন নিয়ে বাংলা যখন উত্তাল তখন অনেকবার কথা হয়েছে। ওঁর কবি ও কবিয়াল শুনে আমি মুগ্ধ-অভিভূত হয়ে গেছি। তবে সেসব কথা পরে হবে। আজ শুধু সেদিনের একটা ছোট্ট ঘটনা বলার লোভ সামলাতে পারছি না। আসলে জয়দার সেন্স অফ হিউমার যে কী সাংঘাতিক সেটা যাঁরা জানেন না তাঁরা এই গল্পটা শুনলে বুঝতে পারবেন।

নাটক নিয়েই কথা হচ্ছিল আমাদের। তার কিছুদিন আগেই আর একজন নাট্যকার, নাম বলছি না, তাঁর একটি নাটক বেশ সাড়া ফেলেছিল। নাটকটা আমি দেখেছিলাম। কিন্তু ভালো লাগেনি। মনে হয়েছিল নাটকে বিষয়ের থেকে যেন আঙ্গিক এবং আড়ম্বরে জোর বেশি। কথাটা জয়দাকে বলাতে, তিনি একটু চুপ করে থেকে তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ধীর-স্থির ভঙ্গিতে বললেন,
জানেন দীপান্বিতা, আমাদের রানাঘাটে স্টেশনের গায়ে একটা ছোট্ট ভাতের হোটেল আছে। ওই যেমন হয় দরমার বেড়া দেওয়া। কাঠের বেঞ্চ। কলাপাতায় ভাত-ডাল। ট্রেন এলেই একটা ছোকরা প্ল্যাটফর্মে গিয়ে চেঁচায় গরম ভাত তৈরি....গরম ভাত তৈরি। গ্রামের লোকজন আসে কিছু। তা সেই হোটেলটার দরমার বেড়ার গায়ে একটা সাইনবোর্ড আছে। তাতে লেখা আছে, দ্য গ্র্যান্ড হোটেল।