দীপান্বিতা রায়ের ছোটবেলা কেটেছে শিল্পশহর বার্নপুরে। স্কুলের পাঠ সেখানেই।তারপর যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা। নবনীতা দেবসেন, মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখের সান্নিধ্যে সাহিত্যের গভীরে যাওয়ার অভ্যাস। পেশায় বৈদ্যুতিন মাধ্যমের সাংবাদিক। লেখালিখির শুরু ২০০৮ সাল থেকে। ইতিমধ্যেই লেখার জগতে পরিচিত নাম। l দীপান্বিতা লেখেন ছোটদের এবং বড়দের জন্যও। তাঁর বড়দের জন্য লেখা বই আঁধার বৃত্ত, রাংতা মোড়া অভিশাপ, মৃত্যুর দূরত্ব আধঘন্টা, ঘুনপোকার শব্দ, ভালোবাসি বৃষ্টিমতে, দেবদূতের কারখানা, ত্রিভুজের চতুর্থ কোণ কিংবা গোপন প্রেমের আপন কথা, পাঠকদের সমাদর পেয়েছে। মিত্র ঘোষের সুবিদিত মাসিক পত্রিকা কথাসাহিত্যে এই প্রকাশিত হয়েছে তাঁর ধারাবাহিক উপন্যাস, শেষ বাঁকে দাঁড়িয়ে। পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক পটভূমির ওপর লেখা তাঁর এই উপন্যাস পাঠকদের মধ্যে রীতিমত সমাদৃত হয়েছে। গল্প-উপন্যাস ছাড়াও তাঁর দুটি রম্য রচনার সংকলন নেই ঠিকানার চিঠি এবং ছোট মুখে বড় কথা-ও পাঠকপ্রিয় হয়েছে। বসুমতী, নবকল্লোল, সানন্দা, পুরশ্রী, বাংলা একাডেমি, অঙ্গীকার, প্রথম আলো পুরুলিয়া দর্পণ, মালিনী, ভূমধ্যসাগর, সই-সাবুদ, আনন্দবাজার রবিবাসরীয়, আজকাল, বিচিত্রপত্র প্রভৃতি পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত তাঁর লেখা গল্প-প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। দীপান্বিতা লেখেন নিজের চারপাশের জগত্ নিয়ে। দৈনন্দিন জীবনের কঠিন বাস্তব, অভ্যস্ত খুঁটিনাটিই তাঁর উপজীব্য। কিন্তু তিনি নিজেকে শুধুমাত্র সেই সীমিত গণ্ডির মধ্যে আটকে রাখেন না। তাঁর লেখার মধ্য দিয়ে অতিক্রম করে যান দৈনন্দিনতার সংকীর্ণতা। তাঁর চরিত্ররা সাধারণ মানুষ হয়েও উন্নীত হয় বৃহত্তর জীবনবোধে। জীবনের প্রতি, মানুষের প্রতি এই ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিই, তাঁর লেখার অন্যতম বৈশিষ্ট।
ছোটদের জন্য রূপকথা , অ্যাডভেঞ্চার, ভূত, গোয়েন্দা কিংবা কল্পবিজ্ঞান সবই তাঁর কলমে সমান মনোগ্রাহী।কিন্তু তাঁর বৈশিষ্ট হল, সব লেখাতেই থাকে মানবিকতার ছোঁয়া। ছোটদের জন্য লেখালিখির তথাকথিত জনপ্রিয় ধারাগুলির বাইরে বেরিয়ে তিনি লেখেন সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের গল্প। তাদের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-যন্ত্রণার ছবি উঠে আসে। তারঁ লেখায় ছেলে-মেয়েরা নিজেদের চারপাশের পরিবেশকে চিনে নিতে পারে। মানুষের লড়াইয়ের গল্প তিনি লেখেন। তাতে কখনও তার চরিত্ররা জেতে আবার কখনও হেরেও যায়, কিন্তু তাদের সবাইকে নিজেদের কাছের মানুষ বলে বুঝে নিতে পাঠকদের অসুবিধা হয় না। তাঁর লেখা মহীদাদুর অ্যান্টিডোট, কর্কট চক্র, গুপী-বাঘার পোলাপান, বাহারে বারো, ইচ্ছেপরীর রূপকথা, বড়োমার বাক্স, পূরণজিতের রত্নভাণ্ডার রীতিমতো উল্লেখযোগ্য নাম।
দীপান্বিতার রূপকথার গল্প বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। কারণ একটা সময় বাংলা শিশুসাহিত্যে যখন রূপকথার গল্প লেখা প্রায় বন্ধ হতে বসেছিল, সেই সময় রাজা-রানি-রাজকন্যাদের নিয়ে গল্প লিখতে শুরু করেন দীপান্বিতা। তাঁর রূপকথার বৈশিষ্ট হল, গল্পের আঙ্গিকে দিদিমা-ঠাকুমার রাক্ষস-খোক্কসের গল্প বলার ধরন বজায় থাকে ঠিকই, কিন্তু বিষয়ে তা হয়ে ওঠে আধুনিক। আজকের ছোটদের মনোজগতের উপযোগী। যে গল্পের সঙ্গে ছোটরা নিজেদের সংযোগ খুঁজে পায়, যে রূপকথা তাদের মধ্যে বিজ্ঞানমনস্ক, ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে সাহায্য করে।
ছোটদের প্রায় সব পত্রিকা আনন্দমেলা, কিশোর ভারতী, শুকতারা, সন্দেশ, ঝালাপালা, আমপাতা-জামপাতা ইত্যাদিতে নিয়মিত তাঁর লেখা গল্প প্রকাশিত হয়।
দীপান্বিতা তাঁর বই মহীদাদুর অ্যান্টিডোটের জন্য ২০২৪ সালে সাহিত্য আকাদেমির বাল সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। এছাড়াও পেয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগের উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী পুরস্কার, গজেন্দ্রকুমার মিত্র সুমথনাথ ঘোষ স্মৃতি পুরস্কার, বীরাঙ্গনা পুরস্কার, সাধনা সেন পুরস্কার এবং দীনেশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় পুরস্কার।
দীপান্বিতা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের শিশু কিশোর অ্যাকাডেমির এক্সিকিউটিভ কমিটির মাননীয় সদস্য এবং অ্যাকাডেমি থেকে প্রকাশিত পত্রিকা চির সবুজ লেখার সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য। অ্যাকাডেমি থেকে প্রকাশিত বেশ কয়েকটি বইও তিনি যুগ্মভাবে সম্পাদনা করেছেন। অ্যাকাডেমির তরফে প্রতিবছর যে আন্তর্জাতিক শিশু চলচ্চিত্র উত্সবের আয়োজন করা হয়, তিনি তারও কমিটি মেম্বার। চলচ্চিত্র উত্সবের ব্রশিওর এবং বুলেটিন প্রকাশনার দায়িত্বও তাঁর ওপরেই থাকে।
দীপান্বিতা তাঁর নিজের লেখা গল্পের ওপর ভিত্তি করে সূর্যের সিঁড়ি এবং দেবতাদের দুষ্টুমি নামে ছোটদের জন্য দুটি গীতিনাট্য রচনা করেছেন। তাঁর লেখা গানে সুর দিয়েছেন প্রখ্যাত সুরকার জয় সরকার। গান গেয়েছেন লোপামুদ্রা মিত্র, শুভমিতা,শ্রীকান্ত আচার্য, রাঘব বন্দ্যোপাধ্যায়, রূপঙ্কর বাগচী, অনিন্দ্য চক্রবর্তীর মতো খ্যাতনামা শিল্পীরা। নাচে অংশ নিয়েছিলেন ঊর্মিলা ডান্স গ্রুপের সদস্যরা ।
দীপান্বিতার লেখা গল্প থেকে নান্দীকারের পরিচালনায় নাটক হয়েছে বাহনের বায়নাক্কা এবং অ্যাস্ট্রোনাটের ঠিকানা। এছাড়া তাঁর লেখা গল্প, জব্দ হলেন রাজামশাই গল্পের নাট্যরূপ দিয়ে পরিচালনা করেন দেবেশ চট্টোপাধ্যায়। ছোটদের নাটক নিয়ে একটি বইও তাঁর সম্পাদনায় শিশু কিশোর অ্যাকাডেমি থেকে প্রকাশিত হয়।
মুম্বই ম্যাক্সমুল্যার ভবন আয়োজিত শিশু সাহিত্যের ওপর আলোচনায় বাংলার হয়ে দীপান্বিতা ছিলেন প্রতিনিধি। এই আলোচনা সভায় বিভিন্ন রাজ্য এবং প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, মায়ানমার থেকেও প্রতিনিধিরা এসেছিলেন।
নবনীতা দেবসেন প্রতিষ্ঠিত বাংলা লেখিকাদের মঞ্চ সই-এর সম্পাদকের দায়িত্বে আছেন দীপান্বিতা। সই থেকে প্রকাশিত পত্রিকা সই-সাবুদের সম্পাদকমণ্ডলীতেও তিনি আছেন।
দীপান্বিতা রায় পেশায় সাংবাদিক। প্রায় তিরিশ বছরের দীর্ঘ তাঁর সাংবাদিক জীবন। প্রথম কয়েক বছর সংবাদপত্রে কাজ করলেও গত প্রায় পঁচিশ বছর ধরে তিনি যুক্ত আছেন বৈদ্যুতিন মাধ্যমের সঙ্গে। বর্তমানে তিনি এবিপি আনন্দের সিনিয়র প্রডিউসার। সাংবাদিকতার কাজে জায়গায় তাঁকে যেমন ঘুরতে হয়েছে তেমনি সৌভাগ্য হয়েছে অনেক বিশিষ্ট মানুষের সাক্ষাত্কার নেওয়ারও। এর মধ্যে আছেন, সত্যজিত্ রায়, মৃণাল সেন, অমিতাভ বচ্চন, অপর্ণা সেন, নবনীতা দেবসেন, তসলিমা নাসরিন, সৌমিত্র চট্টেপাধ্যায়, বিনায়ক সেন, ঋতুপর্ণ ঘোষ, কল্পনা লাজমি, ভূপেন হাজারিকা, গৌতম ঘোষ, সৈয়দ হাসান ইমাম (বাংলাদেশ ), সেলিনা হোসেন ( বাংলাদেশ), সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, কেতকী কুশারি ডাইসন প্রমুখ, মমতাশঙ্কর, বিকাশ ভট্টাচার্য, যোগেন চৌধুরি, রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ। এরকম ৩১টি সাক্ষাৎকার সম্বলিত তাঁর একটি বই কথা-কফি-কলম নামে প্রকাশিতও হয়েছে।
দীপান্বিতার নেশা বই পড়া। ভালোবাসেন বেড়াতে যেতে, মানুষের সঙ্গে মিশতে আর ছবি তুলতে। দেশের ভিতরে যেমন তিনি বেড়াতে গেছেন, তেমনি বাইরের দেশ যেমন তুরস্ক, রোমানিয়া, অস্ট্রিয়া, জার্মানি, সুইত্জারল্যান্ড, ফ্রান্স, ইটালি প্রভৃতি দেশ বেড়ানোর সুযোগও তাঁর হয়েছে।