আমার ছোটবেলা কেটেছে রাঢবঙ্গে। সেখানে গ্রীষ্মকাল মানে একটা বেশ ভয়াবহ ব্যাপার। পয়লা বৈশাখের নাচ-গান-নাটক যখন হচ্ছে তখনও পর্যন্ত আবহাওয়া মোটামুটি সহনীয়। কিন্তু এপ্রিলের শেষ থেকেই আকাশ একটা বেশ জ্বলন্ত কড়াইয়ের রূপ ধারণ করে সকাল হতে না হতে আগুন ঢালতে শুরু করে দিত ।সেসব দিনে মোটামুটি আলো ফুটতে না ফুটতে দিন শুরু হয়ে যেত। সবাই চেষ্টা করত ভোর ভোর বাইরের কাজ সেরে নিতে। বেলা একটু বাড়লেই রাস্তাঘাট ফাঁকা। মাঝেমধ্যে শুধু আরাবল্লীর দস্যুদের মতো মুখ-মাথা সব কাপড়ে ঢেকে সাঁ-সাঁ করে সাইকেল কিংবা স্কুটার চালিয়ে যাচ্ছে দু-চারজন নেহাত বেচারা। এহেন গরমের দিনে আমার সকালে ঘুম থেকে উঠেই প্রথম কাজ ছিল টুথব্রাশ পরীক্ষা করা। শুনে হাসি পাচ্ছে তো ? হাসবেন না। রীতিমতো বৈজ্ঞানিক ব্যাপার। তখন ওইসব এলাকায় গ্রীষ্মকাল মানে ঠা ঠা গরম। বাতাসে জলীয় বাষ্পের ব টুকুও নেই। ফলে দাঁতমাজার ব্রাশ একেবারে শুকনো খড়খড়ে হয়ে থাকত। খুব ভালো করে জলে ভিজিয়ে না নিলে মাড়ি ছড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। কিন্তু এরমধ্যে যেদিন সকালে দেখা গেল ব্রাশ একটু নরম সেদিন বাড়িতে একেবারে আনন্দের ঢেউ। সবাই অপেক্ষা করে থাকতাম। দুপুর একটু গড়াতেই আকাশ ধীরে ধীরে কালো হয়ে উঠত।ঈশান কোণ থেকে গম্ভীর মুখে এগিয়ে আসত মেঘের দলবল। তারপর একসময় শুরু হতো প্রলয় নাচন। বড় বড় গাছের ঝুঁটি ধরে নাড়িয়ে, গরম হালকা বাতাসকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে ছুটে আসতো ঝোড়ো ঠাণ্ডা হাওয়া। পাড়া-পড়শির গাছ থেকে আম আর বেল পড়তো ঢুপঢাপ। আমরা ছুটতাম আম কুড়োতে।বেলও কুড়োনো হতো, তবে আমের আকর্ষণ স্বভাবতই বেশি। আমতলায় ছুটোছুটির মধ্যেই শুরু হয়ে যেতো ঝমঝম বৃষ্টি। ভেজা মাটি থেকে উঠে আসা সোঁদা গন্ধ আর বৃষ্টির ফোঁটা গায়ে মেখে স্নান, সে এক অনির্বচনীয় অনুভূতি। অমনটা আর জীবনের কোনও পর্যায়েই বোধহয় পাওয়া সম্ভব নয়। মাঝে-মধ্যে শিলাবৃষ্টি হলে সেই আনন্দে একটু বাড়তি মাত্রা যোগ হত। বাগানের কোণে, গাছের শিকড়ের খাঁজে জমে থাকা সাদা ধপধপে শিল কুড়িয়ে আনা ছিল একটা দারুণ ব্যাপার। প্রবল ঝড়-বৃষ্টির পর প্রকৃতি যখন আবার শান্ত হত, ততক্ষণে তাপমাত্রা নেমে গেছে অনেকখানি। বাগান থেকে ভেসে আসছে সদ্য ফোটা বেলফুলের সুগন্ধ। বাড়ি থেকে একটু দূরেই একটা বেশ ঝাঁকড়ামথা বকুল গাছ ছিল। ঝড়ের পর বকুলতলা ফুলে ভরে গেছে। সবমিলিয়ে দহনজ্বালা থেকে অন্তত সাময়িক মধুর স্বস্তি।
গরমের দিনে এইসব এলাকায় বৃষ্টির জন্য মানুষ অপেক্ষা করত চাতকপাখির মতো। ঘরে ঘরে এসি মেশিন তখন কল্পনার অতীত। তাই বৃষ্টি মানে জ্বালাপোড়া গরম থেকে একটু অন্তত রেহাই। সেজন্য বৃষ্টি যাতে হয় তারজন্য তুক ছিল নানারকম। শুনেছি আমার ঠাকুমা বড়ি দিলে নাকি সেদিন নির্ঘাৎ মেঘ করত। আমি অবশ্য তাঁকে বড়ি দিতে দেখিনি। কিন্তু গল্প শুনেছি মায়ের কাছে। গরম যখন একেবারে অসহ্য হয়ে উঠছে, দিনের পর দিন কেটে যাচ্ছে, আকাশে মেঘের ছায়াটুকুও নেই, তখন শুরু হত ঠাকুমাকে অনুরোধ-উপরোধ। তবে ঠাকুমাও এই তুকের কথাটা জানতেন তাই সহজে রাজি হতেন না মোটেই । শেষপর্যন্ত হাল ধরতো আমার পিসতুতো দিদি। দিদিমণি আদরের নাতনির আবদার ফেরাতে পারতেন না। অতএব আগের দিন রাতেই গামলায় কলাইয়ের ডাল ভেজানো হত। সকালে মিহি করে বাটা হত সেই ডাল। তারপর কুলোয় পাতলা কাপড় বিছিয়ে নিখুঁতভাবে নাক তুলে তুলে বড়ি দিতেন ঠাকুমা। সেই বড়ি খোলা উঠোনে শুকোতে দিয়ে স্নান-খাওয়া সারতে যেত সবাই। আর সেই সুযোগে পশ্চিম আকাশে ধেয়ে আসতো কালো মেঘ। সাত ঘোড়ার রথ গুটিয়ে ভয়ে লুকিয়ে পড়ত সূর্য। শুরু হত গুরুগুরু মেঘের গর্জন। রাগে গরগর করতে করতে ঠাকুমা যখন ভিতরকাঁচা বড়ির কুলো তুলছেন ততক্ষণে বড়বড় দু-চার ফোঁটা পড়তে শুরু করেছে। আর বাড়িসুদ্ধ লোক সেই জল গায়ে মাখতে নেমে পড়েছে উঠোনে।