বাঁ দিকে মুচকুন্দ গাছ; ডান দিকে পাকা মুচকুন্দ ফুল

আমার মামারবাড়ি ছিল ধানবাদে। ছিল বলি কেন, এখনও আছে। মামা থাকেন ধানবাদেই। তবে আগে যেমন মামা-মাসি-দিদিমা-বড়মামা এরকম নানা আত্মীয়স্বজন মিলে একটা বেশ জমজমাট ব্যাপার ছিল এখন আর জীবনের স্বাভাবিক নিয়মেই তা নেই। যেসময়ের কথা বলছি, তখন আমি বেশ ছোট। সম্ভবত ক্লাস ফোর-ফাইভে পড়ি। দাদু আমার মায়ের বিয়ের আগেই চলে গেছিলেন। জ্ঞানত আমি প্রথম যেটাকে মামাবাড়ি বলে চিনেছি সেটা ছিল আমার বড়মামা মানে মায়ের জাঠতুতো দাদার কোয়ার্টার। পরে দিদা নিজে বাড়ি করেছিলেন এবং বড়মামা কোডারমা বদলি হয়ে গেছিলেন। বড়মামার বদলি হওয়া এবং দিদার বাড়ি বাসযোগ্য হয়ে ওঠা এই সংক্ষিপ্ত সময়টুকুতে মামাকে নিয়ে দিদা একটা ছোট বাড়িতে ভাড়া ছিলেন। সেটা কোথায় ছিল এখন আর মনে নেই। তবে সেখানে যেতে হত ইন্ডিয়ান স্কুল অফ মাইনসের ক্যাম্পাসের ভিতর দিয়ে। একবারই মাত্র আমি মায়ের সঙ্গে সেই বাড়িতে গেছিলাম। সেটা ছিল মার্চ মাস। দিদার সঙ্গে আমি সকালবেলা বেরিয়েছি মাসির বাড়ি যাব বলে। মাসির বাড়িটা ছিল ওই ক্যাম্পাসের ঠিক বাইরেই। ধানবাদ শহরটা তেমন সাজানো-গোছানো না হলেও, ইন্ডিয়ান স্কুল অফ মাইনসের ক্যাম্পাসটি ভারি সুন্দর। বিশাল বড় এবং অজস্র গাছে ভর্তি। ভিতরে চমৎকার পিচ ঢালা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাস্তা। পরবর্তী সময়ে ওই ক্যাম্পাস খুব ভালো করে ঘুরে দেখার সৌভাগ্যও আমার হয়েছে, কারণ মামা এবং আমার বোন - ভগ্নিপতি দুজনেই সেখানেই পড়াতেন। তবে সেসবই হল অনেক পরের কথা। দিদার হাত ধরে সেদিন আমি মুগ্ধ চোখে দুপাশের গাছপালা দেখতে দেখতে যাচ্ছি।বসন্তাকাল। চারিদিকে নানারকম ফুল ফুটেছে। গন্ধও পাওয়া যাচ্ছে। হঠাৎ দিদা বলল,

দাঁড়া এগুলো একটু কুড়িয়ে নিই.....

আমি অবাক হয়ে দেখি ঘাসের ওপর হালকা হলুদ রঙের পাপড়ির কী যেন একটা লম্বা লম্বা ফুল পড়ে আছে।খুব একটা সুদৃশ্য কিছু নয়। দেখে ফুল বলে মনেও হয় না। পাপড়িগুলো আমার আঙুলের মতোই মোটা আর নরম। জিনিসটা কী না বুঝেই আমিও মহা উৎসাহে দিদার সঙ্গে কুড়োতে লাগলাম। তখন তো ওসব প্লাস্টিকের বালাই নেই। দিদার কাছে থলি বা ব্যাগও ছিল না। কিন্তু তাতে কোনও অসুবিধা হল না। সাধারণ করে পরা শাড়ির আঁচলেই দিব্যি বেঁধে নিল ফুলগুলো। তারপর আমরা মাসির বাড়ি গিয়ে, গল্পগাছা করে কিছুক্ষণ পরে বাড়ি ফিরে এলাম। ততক্ষণে মাসতুতো ভাইদের সঙ্গে খেলাধুলোর আনন্দে কুড়োনো ফুলের কথা আমি ভুলে গেছি।

বিকেলে যখন একঘুম দিয়ে উঠেছি, তখন দিদা একখানা পাথরের গ্লাস আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,

দ্যাখ দেখিনি খেয়ে.....

চুমুক দিলাম। মিছরির সরবতের স্বাদ জিভে লাগল। তারসঙ্গে এক অপূর্ব সুগন্ধে সমস্ত শরীর-মন যেন স্নিগ্ধ-শীতল হয়ে গেল। মুচকুন্দ ফুলের সুগন্ধের সঙ্গে সেই আমার প্রথম পরিচয়।মিছরির সঙ্গে মুচকুন্দ ফুলের হলদে হয়ে যাওয়া পাকা পাপড়ি কুচিকুচি করে কেটে ভিজিয়ে রেখেছিল দিদা। তার সঙ্গে কুঁজোর ঠাণ্ডা জল মিশিয়ে তৈরি হয়েছে সরবত। সেসব দিনে বাঙালি মধ্যবিত্তের বাড়িতে রেফ্রিজারেটর থাকত না। সেবার যেকদিন ছিলাম রোজই দিদা ওই সরবত আমার জন্য বানিয়ে দিত। একটি করে ফুল বালিশের পাশেও রেখে দিত, যাতে সারারাত তার সুগন্ধ পাই।

দাদু - দিদিমা

পরে বড় হয়ে সাহিত্যে মুচকুন্দ ফুলের সঙ্গে পরিচয় হল। চোখের বালি উপন্যাসে বিনোদিনী মহেন্দ্রর জন্য মুচকুন্দ ফুলের সরবত বানিয়েছিলেন। মহেন্দ্রর বালিশের তুলোর সঙ্গেও মেশানো হয়েছিল ফুলের রেণু। তারাশঙ্করের জলসাঘর গল্পে এবং সত্যজিত রায়ের ছবিতেও মুচকুন্দ ফুলের উল্লেখ আছে। বসন্তের বাতাস দিচ্ছে বুঝে জমিদার বিশ্বম্ভর চৌধুরী মুচকুন্দ ফুলের সরবত বানানোর নির্দেশ দিচ্ছেন। বিভূতিভূষণের লেখাতেও মুচকুন্দ ফুলের উল্লেখ আছে।

মুচকুন্দ ফুল যে তারপরে আর দেখিনি তা নয়। রাস্তাঘাটে অনেকসময়ই চোখে পড়েছে। বাতাসে ভেসে আসা সুগন্ধ খোঁজ দিয়েছে। মস্ত গাছ। নিচে ফুল পড়ে আছে তাও দেখেছি। কিন্তু তুলে এনে সরবত বানানোর সুযোগ হয়নি। সম্প্রতি শান্তিনিকেতনে ছোট একটি আস্তানা হয়েছে। সেই আবাসনের চত্বর জুড়ে অজস্র গাছ। তারমধ্যে হঠাৎ দেখি একপাশে মুচকুন্দ গাছের সারি। ফুলও ফুটেছে অনেক। নিচেও পড়ে আছে পাকা ফুল। আমাদের আবাসনের একটি নিজস্ব সাজানো-গোছানো হেঁশেল আছে। সেখানে মুচকুন্দ ফুলের সরবতের রেসিপিটা দিয়ে বলে এসেছিলাম এই অভিনব রাবীন্দ্রিক সরবত কিন্তু চালু করতে পারলেই সুপারহিট। মুখে খুব উৎসাহ দেখালেও কাজে এখনও কিছু এগোয়নি। আসলে লেখালিখি করি তো। ধরে নিয়েছে মাথায় অল্পবিস্তর গণ্ডগোল থাকতেই পারে। কুছ্ পরোয়া নেই। ঠিক করে ফেলেছি আগামী বছর নিজেই দিদাকে মনে মনে নমস্কার ঠুকে বানিয়ে ফেলব মুচকুন্দের সরবত। বসন্তকালে সবার তাই আগাম নিমন্ত্রণ রইল।