বাবার সঙ্গে হাসান ইমাম

প্রথম আলাপের দ্বিতীয় পর্বে এমন একজনের কথা বলব, যিনি আমাদের দেশের মানুষ নন। প্রতিবেশী বাংলাদেশের নাগরিক। অসুস্থতার কারণে গত কয়েক বছর যাবৎ তাঁকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ছেলের কাছে থাকতে হচ্ছে, কিন্তু তাঁর কর্মজীবন পুরোটাই কেটেছে বাংলাদেশে। যদিও তাঁর বেড়ে ওঠা এই বঙ্গে, পশ্চিমবাংলার বর্ধমান জেলায়। অজিতেশের মতোই তিনিও আমার পিতৃবন্ধু, সহপাঠী, তাঁর নাম সৈয়দ হাসান ইমাম। বাংলাদেশের একজন প্রথিতযশা অভিনেতা এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। গল্প শুনেছি তাঁর অভিনীত ছবি দেখার জন্য যেমন সিনেমা হলে লাইন পড়তো, ঠিক তেমনি তাঁর বক্তৃতা শোনার জন্যও রাতদুপুরে মানুষের ভিড় জমতো। বামপন্থী রাজনীতিতে বিশ্বাসী। বামপন্থী পরিবেশে বড়ও হয়েছেন। তাঁর মামা মনসুর হবিবুল্লাহ একসময় আমাদের বিধানসভার স্পিকার ছিলেন। ছাত্রজীবন শেষ হওয়ার পর সৈয়দ হাসান ইমাম চলে গেছিলেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকাতে। সেখানেই ছবিতে অভিনয় করা শুরু করেন তিনি। আমি যখন তাঁকে প্রথমবার দেখি তখন আমার বয়স নিতান্তই কম। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় স্ত্রী এবং মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে আসতে হয়েছিল, কারণ বেশ একটা বড় অঙ্কের টাকা তাঁর মাথার দাম ধার্য হয়েছিল। সেই সময় একবার আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন। সেই প্রথম মানুষটির সঙ্গে পরিচয়। কিন্তু সেই পরিচয়কে তো আর আলাপ বলা যায় না। তাই আলাপের পর্বটা বলে নিয়ে প্রথম দেখার কথায় আবার ফিরে আসব।

তরুণ বয়সে হাসান ইমাম

বাংলাদেশ স্বাধীন হওযার পর সৈয়দ হাসান ইমাম এবং তাঁর পরিবার দেশে ফিরে যান। স্বাভাবিকভাবেই বাবার সঙ্গে এরপর যোগাযোগ প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। দুজনেই তখন জীবন সংগ্রামে ব্যস্ত। তাছাড়া তখন তো যোগাযোগের মাধ্যম বলতে চিঠি। একটা বয়সের পর বন্ধু-বান্ধবকে চিঠি লেখার সময় আর কজনেরই বা থাকে। তবে তাঁর ঢাকার ঠিকানাটা বাবার কাছে কীভাবে জানি থেকে গেছিল। যদিও সেই ঠিকানা বদলে গেছে কিনা জানার কোনও উপায় ছিল না। এভাবেই কেটে গেল প্রায় দুই দশক। আমার বিয়ের দিন স্থির হওয়ার পর বাবা কোনওরকম প্রত্যাশা না রেখেই একটি চিঠি লেখেন বন্ধুকে। প্রথম কন্যার বিয়ে, যদি আসতে পারো ভালো লাগবে। সৈয়দ হাসান ইমাম, আমার হাসানকাকু এলেন বিয়েতে। দুই দশক পরে, সীমান্ত পেরিয়ে বন্ধুর আমন্ত্রণে তার মেয়ের বিয়েতে যোগ দিতে। আমার সঙ্গে আলাপ হল কাকুর। ওই বয়সেও অসম্ভব সুপুরুষ। অপূর্ব গানের গলা। বাবার কাছে শুনেছি ক্রিকেট খেলতেন চমৎকার। কিন্তু এসবই হল বাইরের গুণ। আসলে মানুষটি কঠোরে-কোমলে মেশানো এক অদ্ভুত ব্যক্তিত্ব। অন্যায় করলে শাসন করতে একমুহূর্ত দেরি করবেন না। আবার আমার কী অসুবিধা হচ্ছে সেটা বাবারও আগে কাকু অনেকসময়ই বুঝে ফেলতেন। পরবর্তীকালে দীর্ঘ একটা সময় রাজনৈতিক কারণে তাঁদের কলকাতায় থাকতে হয়েছিল। তখন খুব কাছ থেকে তাঁকে দেখেছি। বহু বিষয় নিয়ে কথা হয়েছে। কাকিমা, প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী লায়লা হাসান। অপূর্ব সুন্দরী। তাঁরও আদর এবং প্রশ্রয় পেয়েছি অনেক। গৌতম ঘোষ পরিচালিত মনের মানুষ ছবিতে দুজনেই অভিনয় করেছিলেন জমিদার এবং তাঁর গৃহিণীর ভূমিকায়।

হাসানকাকু ও কাকিমা

হাসানকাকুর সঙ্গে প্রথম আলাপের বিস্তার করার জায়গা এটা নয়। তবে এটুকু না বলে পারছি না, ঘনিষ্ঠ বৃত্তে কাকু-কাকিমা দুজনেই আমাকে তাঁদের বড় মেয়ে বলেন। আজকের লেখা কিন্তু শেষ করব প্রথম দেখার স্মৃতির ছোট্ট একটু অংশ দিয়ে। যদিও সেটা সবটা আমার নিজের মনে আছে, নাকি মায়ের মুখে শোনা কথাকেই নিজের বলে ভাবছি বলতে পারব না। সেইসময় মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যার্থে বাংলাদেশের শিল্পীরা বেশ কিছু সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করেছিলেন। সেরকমই একটি অনুষ্ঠান করতে দলের সঙ্গে বার্নপুরে এসেছিলেন কাকু। কাকিমা আর আমার প্রায় সমবয়সী ওঁদের বড় মেয়ে সঙ্গীতাও ছিল। ওঁরা উঠেছিলেন আমাদের বাড়িতে। মায়ের একটা সাদার ওপর সবুজ কাজ করা ঢাকাই শাড়ি কাকিমা পরেছে দেখে ভারি বিস্মিত হয়েছিলাম সেটা মনে আছে। যেদিন ওঁরা চলে যাবেন তার আগের দিন সন্ধেবেলা। বসার ঘরে বাবা আর কাকু বসে আছেন। আমাদের একটা বেশ ঢাউস বাক্সের মতো রেকর্ড চেঞ্জার ছিল। তাতে দেবব্রত বিশ্বাসের গলায়, পুরানো সেই দিনের কথা......বাজছে। মা বোধহয় বাবাকে কিছু বলতে ঘরে ঢুকতে যাচ্ছিলেন। কাকিমা হাত চেপে ধরে বললেন,
যেও না, ওদের একলা থাকতে দাও.....
আমি খুব অবাক হয়ে উঁকি মেরে দেখলাম বাবার চোখ দিয়ে জল পড়ছে।
দুই বন্ধুর আবার দেখা হতে দুই দশক পেরিয়ে গেছিল।