বছর শুরু গ্রীষ্মে। তাই তাকে দিয়ে শুরু করাই ভালো। যদিও গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এর কল্যাণে ইদানীং গ্রীষ্মের বোলবোলাও বড্ড বেড়েছে। ফাল্গুন মাস শেষ হতে না হতে সূর্যদেব যেন কেমনধারা কটমট করে তাকাতে শুরু করেন। দখিনা বাতাসে যেন বারুদের গন্ধ। তারওপর আজকাল একটা নতুন শব্দও চালু হয়েছে খুব , তাপপ্রবাহ। আবহাওয়া অফিসের পণ্ডিতরা যেন টিকি নেড়ে বসে আছেন। ক্যালেন্ডারে গরমকাল এলো কি এলো না অমনি মস্ত এক তাপমাত্রার তালিকা ধরিয়ে দিয়ে হুঁশিয়ারি দিতে শুরু করে দিলেন। আসছে আসছে....তাপপ্রবাহ আসছে....ঘুর্ণিঝড়ের মত ধেয়ে আসছে গরমের স্রোত....সাবধান....সাবধান। তারপর তো জল খাও, ফল খাও, মাথায় টুপি দাও, ছাতা নাও.....চলতেই থাকবে। যতক্ষণ না কালো মেঘের দলবল রেগেমেগে আকাশের সঙ্গে যুদ্ধ করতে নেমে পড়ে।
আমাদের ছোটবেলায় কিন্তু এত গরম পড়ত না। কিংবা হয়তো ছোটকালে গরম অতটা গায়েও লাগে না। যদিও থাকতাম একেবারে খোদ গরমের জায়গা, রাঢ় বঙ্গে। এপ্রিলের গোড়া থেকেই চড়বড়িয়ে রোদ। মে মাসে মর্নিং স্কুল। কারণ দুপুর হতেই গরম হাওয়া বইবে। নাকে কাপড় বেঁধে, আমপোড়ার সরবত খেয়ে লু-এর প্রকোপ থেকে বাঁচতে হত। অনেকে আবার পকেটে সাদা পেঁয়াজ রাখতেন, তাতে নাকি লু লাগে না। এরকম অদ্ভুত তুকে কাজ হত কিনা আমার অন্তত জানা নেই। তবে প্রবল গরমের সময় লু লেগে বেশ কিছু মানুষজনকে যে হাসপাতাল সই হতে হত সেটা জানতে পারতাম।
যখন একটু বড় হয়েছি, মানে গরম উপেক্ষা করে খেলতে বেরোনর মতো শরীরের ক্ষমতা হয়েছে তখন আমরা থাকতাম ইস্কোর কলোনিতে একটা ছোট কোয়ার্টারে। তার ছোট্ট বাগানে ছিল তিনটে মস্ত গাছ, অশ্বথ্থ, নিম আর পেয়ারা। বাড়ির সামনেই একটা ঝাঁকড়া রাধাচূড়া। গায়ের কোয়ার্টারে বিশাল ছড়ানো বেল গাছ। সব মিলিয়ে বেশ একটা ছায়া-ছায়া ভাব। সূয্যি ঠাকুরকে আটকে দেওয়ার ব্যবস্থা। প্রতিবেশীদের আপত্তি সত্ত্বেও বাবা কিছুতেই গাছের ডাল কাটতে দিতেন না। তাই গরম কিছুটা কম হতো। তবে গরম বেশি-কমে আমার বিশেষ কিছু আসত যেত না। স্কুলের গরমের ছুটি পড়ে যেত মে-র মাঝামাঝি। ছুটির দিনে সকালে এগারোটা পর্যন্ত ছিল পড়াশোনার পালা। তারপরেই ওই ঝাঁ ঝাঁ রোদ্দুরে একদৌড়ে রাস্তায়। নানারকম খেলা ছিল তখন। সবথেকে ছোটর দল খেলত লাল লাঠি। লাঠি নিয়ে ছোটাছুটি। লাল রঙে লাঠি ছোঁয়াতে না পারলেই চোর। কলোনির ফাঁকা রাস্তায় গাড়ি-ঘোড়া চলত না মোটেই। তাই সেটাই ছিল মাঠের বিকল্প। লাল লাঠির পরবর্তী পর্যায়ে খেলা শুরু হল কিৎকিৎ। চৌকো, গোল নানারকম ঘর কেটে। চ্যাপ্টা খোলামকুচি তখন রাজঐশ্বর্য, তাতে তো টিপ করতে সুবিধা। একবারে সব ঘর কিনে ফেলার মত এক্সপার্টাইজ যখন হয়ে গেল, তখন উন্নীত হলাম ধাপসায়। সেও রাস্তায় ঘর কেটে, অনেকে মিলে খেলা। একসময় নিতান্ত দুধভাত থেকে শেষপর্যন্ত পোক্ত খেলুড়ে। তারপর বড় হয়ে গেলাম। গরমের দুপুর ভরিয়ে দিল পড়ার আর গল্পের বই।