নামটা বেশ অদ্ভুত তাই না ? আসলে কিছু ছিষ্টিছাড়া খাবারের কথাই তো লিখব। এবার সেটা টেস্টি কিনা সে তো যিনি খাবেন তিনি বুঝবেন। কারণ খানা তো সবসময়ই আপরুচি। আমার টেস্টি লাগে। তার পিছনে অনেক কারণ থাকতে পারে। জিভের স্বাদকোরকের সঙ্গে মিলে-মিশে যেতে পারে স্মৃতির রং, মনখারাপের মেদুরতা।
প্রথম যে ছিষ্টিছাড়া খাবারটির কথা বলব ঠিক করলাম সেটি হল কুসুম বীজ। রাঢ় বাংলায় কুসুম গাছ দেখা যায়। বসন্তে যখন কচি পাতা গজায় তখন সেই পাতার রং থাকে টুকটুকে লাল। দূর থেকে দেখলে মনে হয় যেন গাছটি লাল ফুলে ভরে আছে। আমি অবশ্য গাছ প্রথমে দেখিনি। ফল কখনও দেখিনি। দেখেছি বীজ। হালকা হলদে রঙের, অনেকটা ধানের মতোই দেখতে, তবে আর একটু গোলগাল। আমার মামাবাড়ি ছিল ধানবাদে। ছিল বলাটা ঠিক হল না, এখনও আছে। মামা এখনও ধানবাদেই থাকেন। তাই ছোটবেলায় বছরে একবার-দুবার আমাদের ধানবাদ যাওয়া হত। মামাবাড়ির নানারকম আকর্ষণের মধ্যে একটা ছিল দিদিমার হাতে চালভাজা মাখা। নানারকম জিনিস দিয়ে চালভাজা মাখতেন দিদিমা। তার অন্যতম উপকরণ ছিল খোলায় ভাজা কুসুমবীজ। দাঁতের হালকা চাপেই মুড়মুড় করে ভেঙে যেত তার সোনালি আবরণ আর মুখের ভিতরে চমৎকার স্বাদ আর সুগন্ধ পাওয়া যেত। দিদিমা চলে গেলেন আমি যখন কলেজে পড়ি। কুসুমবীজের সঙ্গে সম্পর্কও ঘুচে গেল। তারও বেশ কয়েকবছর পরে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে বেরোনর পর আমরা বন্ধুরা মিলে বেড়াতে গেছিলাম বাংরিপোসি। তখন সেই জায়গা একদম নির্জন, শুনশান। বিকেলবেলা হাঁটতে বেরিয়ে দেখি একটু দূরে মাঠের মধ্যে তিনটি গাছ যেন ফুলে আলো করে আছে। স্থানীয় মানুষদের জিজ্ঞাসা করে জানা গেল ও হল কুসম গাছ। ফুল নেই। লাল পাতার রাঙা নেশায় মেশা তাদের ঝাঁকড়া মাথা। তবে গাছ দেখলেও ফুল বা ফল দেখিনি কখনও। শুনেছি নাকি টক-মিষ্টি স্বাদের সুন্দর ফল হয়।
বছর দুয়েক আগের কথা। শান্তিনিকেতনে একটি ছোট আস্তানা হওয়ার সুবাদে মাঝে-মধ্যে যাওয়া হয়। শীতকাল। বেশ জমিয়ে ঠাণ্ডা পড়েছে। সন্ধেবেলা বেরিয়ে সবার ইচ্ছা হল গরম চা-এর সঙ্গে আলুর চপ খাওয়ার। আমার বন্ধু চিত্রলেখার রবিঠাকুরের দেশের সবকিছু নখদর্পণে। তার কাছে জানা গেল ক্যানালের ধারের রাস্তায় শিশুতীর্থ স্কুলের কাছে একটা চা-এর দোকান আছে। সেখানে নাকি দারুণ আলুর চপ, পেঁয়াজি ভাজে। হৈহৈ করে সবাই মিলে সেখানে গিয়ে হাজির। দুই মহিলা দোকানটি চালান। বলতেই তারা শালপাতায় পরিবেশন করলেন গরম আলুর চপ। আর সেই চপে কামড় দিয়েই আমি চমকে উঠলাম। যেন বহু যুগের ওপার থেকে জিভে ভেসে এল সেই স্বাদ, দাঁতের চাপে মুড়মুড় করে ভেঙে ছড়িয়ে গেল মুখের ভিতরে। হঠাৎ মনে হল কাঠের বারকোশটায় চালভাজা মাখছে দিদা আর বাটি নিয়ে তার সামনে বসে আছে দুবিনুনি ঝোলানো টিঙটিঙে রোগা এক মেয়ে। রাঁধুনি জানালেন আলুর চপের ওপর কুসুম বীজ ছড়িয়ে দেন তাঁরা, তাতে নাকি বাড়তি সোয়াদ হয়। নিশ্চিত হয়। আমি তো অন্তত নিশ্চিত। এতকাল বাদে কুসুমবীজকে আবার ফিরে পেয়ে এককথায় আত্মহারা।