পেশায় সাংবাদিক। সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে যোগ প্রায় তিরিশ বছরের। কাজের সূত্রেই বহু বিশিষ্ট মানুষের সঙ্গে আলাপ হয়েছে। সেই আলাপ কখনও পরবর্তীকালে ঘনিষ্ঠতায় গড়িয়েছে। আমি তাঁর কাছের মানুষ হয়ে উঠতে পেরেছি। কখনও আবার প্রথম আলাপেই পরিচয়পর্ব শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু আমার নিজের কাছে এই প্রতিটি পরিচয়েরই আলাদা মূল্য আছে। সেই দিনটি আমার কাছে সবসময় বিশেষ। তাই কীভাবে এই পরিচয়পর্ব শুরু হল তাই নিয়েই এই লেখা। তবে একদম প্রথমে যাঁর কথা লিখতে চাই, যাঁর কথা কখনও কোথাও লিখিনি, তাঁর সঙ্গে আলাপে আমার পেশাদারি জীবনেরও কোনও যোগ নেই। কারণ তখন আমি নিতান্তই স্কুল পড়ুয়া। কিন্তু তিনি আমার জীবনে প্রথম কাছ থেকে দেখা বিশিষ্ট মানুষ। তাই তাঁকে দিয়েই শুরু করছি লেখা। তিনি অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়। আমার বাবার বিশেষ বন্ধু। বলা ভালো আমাদের পারিবারিক বন্ধু। কারণ শুধু বাবা নয় আমার জেঠুর সঙ্গেও তাঁর খুবই ঘনিষ্ঠতা ছিল। আমার পিতামহ এবং অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাবা একই জায়গায় চাকরি করতেন। ফলে পাশাপাশি দুটি কোয়ার্টারে ছিল দুই পরিবারের বাস। বন্ধুত্ব হয়েছিল। অজিতেশ চলে গেছেন অনেক বছর। কিন্তু সেই পারিবারিক ঘনিষ্ঠতা এখনও বজায় আছে।

অজিত জেঠুর সম্পর্কে বাবার কাছে গল্প শুনেছি অনেক ছোটবেলা থেকেই। তাঁর স্কুলে পড়তে অসাধারণ রচনা লিখে প্রথম হওয়ার গল্প। নাটক নিয়ে পাগলামি। বাবার কলকাতায় গিয়ে নাটক দেখার অভিজ্ঞতা, এরকম অনেক কিছু। কিন্তু আমরা তখন থাকি শিল্পশহর বার্নপুরে। অজিতেশের কর্মস্থল কলকাতা। দুই শহরের মধ্যে দূরত্ব সেদিনের প্রেক্ষিতে অনেক। তাই দেখা যখন হল তখন আমি ষষ্ঠ শ্রেণি, তখন আমি এগারো। বার্নপুরের ভারতী ভবন ক্লাবে সেসময় প্রতিবছর বঙ্গসংস্কৃতি উৎসব হত। সেবছর জানা গেল নান্দিকারের দুটি নাটক আসছে, আন্তিগোনে এবং ভালোমানুষ। বাবা তাঁর নিজস্ব নীতি মেনে আগেই টিকিট কেটে ফেললেন। আমি সঙ্গে যাব।যদিও ওই ধরনের নাটক দেখার বয়স আমার তখনও হয়নি, কিন্তু বাবা খুব ছোটবেলা থেকেই আমাকে নাটক দেখাতে নিয়ে যেতেন।

প্রথমদিন আন্তিগোনে। রাজা ক্রেয়নের ভূমিকায় অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়। আন্তিগোনে কেয়া চক্রবর্তী। পরবর্তীকালে অনেকসময় খুব গর্ব করে বলেছি যে আমি অজিতেশ অভিনীত ক্রেয়ন দেখেছি। কিন্তু আসল কথা হল তখন কিছুই বুঝিনি। নাটকের মূল গল্পটা অবশ্য বুঝতে খুব একটা অসুবিধা হয়নি। আর ওরকম একজন দীর্ঘদেহী মানুষ মঞ্চের ওপর দাপিয়ে বেড়াচ্ছেনা, তাঁর জলদগম্ভীর গলার স্বরের ওঠানামায় মানুষকে মোহাবিষ্ট করে ফেলছেন, সেটাও বুঝতে অসুবিধা হয়নি। নাটক শেষ হওয়ার পর বাবার নাম ঘোষণা করে বলা হল যদি এসে থাকেন তাহলে মঞ্চের পিছনে যেতে। বাবা কিন্তু অজিতেশকে জানাননি যে তিনি নাটক দেখতে যাবেন। তখন তো আর ফোন নেই। চিঠিপত্রও লেখা হত কমই। কিন্তু তিনি বার্নপুরে নাটক করতে আসবেন আর দর্শকাসনে মনোরঞ্জন থাকবে না এটা যে সম্ভব নয় অজিতেশ জানতেন। বন্ধুত্বের এমনই টান।

যাই হোক্, গেলাম আমরা। বিশাল লম্বা একজন মানুষ। ক্রেয়নের পোশাকটা ছিল হালকা বেগুনি রঙের। মুখের মেক-আপ তোলেননি তখনও। সেই অবস্থাতেই বসে পড়লেন গল্প করতে। ততক্ষণে জড় হয়েছেন আরও অনেকে। সবাইকে সম্বোধন করছেন। প্রণাম করলে পিঠে হাত রাখছেন। মাঝখানে কেয়া চক্রবর্তীও এলেন কিছু একটা সমস্যা নিয়ে। তারমধ্যে বাবার সঙ্গে আমার সঙ্গে কথা চলছে। হঠাৎই আমি কোন ক্লাসে পড়ি সেই প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে বাবা বললেন যে আমার খুব গল্পের বই পড়ার নেশা। পড়ার বইয়ে মনোযোগ তেমন নেই। আশ্চর্য ব্যাপার কথাটা শুনে সেই বিশাল মানুষটি ভীষণই খুশি হয়ে গেলেন। পড়ার বই না পড়ে বাচ্চা মেয়ে গল্পের বই পড়ে শুনে ওরকম খুশি হতে আমি তার আগে বা পরে বিশেষ কাউকে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। আমি অঙ্কে কত পাই কিংবা ক্লাসে ফার্স্ট হই কিনা সেসব কিচ্ছু তিনি জানতে চাননি। বরং গল্পের বইয়ের নেশা আছে বলে দারুণ একটা পুরস্কার প্রাপ্তি হয়েছিল। আমাকে সেদিন ওখানে বসেই অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর নানান রঙের দিনগুলি নাটকের একটা অংশ শুনিয়েছিলেন। নাটকটি দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি।অজিতেশের হাতে গোণা দু-একটি নাটকই আমি দেখেছি। আমি পড়াশোনা করতে কলকাতায় আসার আগেই নিতান্ত অকালে তিনি আমাদের ছেড়ে চলে যান। কিন্তু সেই একটি সন্ধেরাত আমার স্মৃতিতে চির অমলিন।

আমার জেঠু নিরঞ্জন রায়কে লেখা অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের চিঠি

এই লেখাটির সঙ্গে আমি তিনটি ছবি দিলাম। প্রথম ছবিদুটি আমার কাকা ডঃ অশোক রায়ের সৌজন্যে প্রাপ্ত। অজিতেশ নিজেই তাঁকে ছবিদুটি দিয়েছিলেন। তারমধ্যে একটি ছবিকে তো প্রায় ঐতিহাসিক বলা যায়। যেখানে আমরা শুধু অজিতেশ নয় সত্যজিৎ রায়, জ্যোতি বসু এবং আরও অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিকে দেখতে পাচ্ছি। তৃতীয় ছবিটি একটি চিঠি। আমার জেঠু নিরঞ্জন রায়কে অজিতেশ চিঠিটি লিখেছিলেন তাঁর ছাত্রাবস্থায়। একেবারেই এক বন্ধুকে লেখা আর এক বন্ধুর চিঠি। সেই আন্তরিকতা এবং অধিকারবোধ এখানে স্পষ্ট।

 

ছবি সৌজন্য: ডঃ অশোক রায়