সেদিন ছিল বছর শেষের চৈত্রমাস। অফিস ফেরতা নবনীতা দেবসেনের ভালো-বাসা বাড়িতে উপস্থিত হয়েছিলাম। ওরকম প্রায়ই যেতাম। একে তো পাঁচবছর যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর সরাসরি তত্ত্বাবধানে তুলনামূলক সহিত্য পড়েছি। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে যাওয়ার পরও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়নি। মহিলা লেখকদের নিয়ে নবনীতাদি সই নাম দিয়ে একটি মঞ্চ করেছিলেন। আমি তখন তার সক্রিয় সদস্য। ফলে কাজকর্মও থাকত নানারকম। প্রায়দিনই দুপুরবেলায় ফোন যেত, ‘অফিস ফেরতা একবার আমার এখানে ঘুরে যাস।‘ আমিও দিব্যি খুশি হয়ে নাচতে নাচতে যেতাম। বাড়তি আকর্ষণও একটা ছিল। অফিস থেকে কেউ আসছে মানে তো তার খিদে পাবে। তাই যাওয়ামাত্রই দিদির ম্যান ফ্রাইডে কানাইদা কিংবা বউমাকে হুকুম হত আমাকে কিছু জলখাবার দেওয়ার। তবে আয়োজনটা যে শুধু আমার জন্য হত তা কিন্তু মোটেই নয়। ভালো-বাসা বাড়িতে অনাহুত অতিথির জন্য প্রতিদিনই বিকেলবেলা জলখাবারের ব্যবস্থা থাকত। সেটাও খুব সাধারণ কিছু নয়। কিমার ঘুগনি কিংবা চিজ বা ফ্রেঞ্চ টোস্ট, পায়েস বা খাস্তা নিমকি এরকম কিছু। সবই বাড়িতে বানানো এবং স্বাদে-গন্ধে অপূর্ব। অনেকেই হয়তো জানেন না যে নবনীতাদি কিন্তু খুব ভালো রাঁধতে পারতেন। যখনকার কথা বলছি, তখন অবশ্য তাঁর পক্ষে আর রান্নাঘরে যাওয়া সম্ভব হত না। কিন্তু বাড়িতে যা রান্না হত, সবই তিনি নিজে হাতে ধরে শিখিয়েছিলেন। আমিও তাঁর কাছে একটি রান্না শিখেছিলাম, সেটা হল মাছের কচুরি। সে গল্প আরেকদিন বলব, আজ যেখানে শুরু করেছি সেই কথায় ফিরি।

চৈত্র মাসের বিকেল। অল্প অল্প গরম পড়তে শুরু করেছে। তবে বিকেল বেলায় সুন্দর হাওয়া দিচ্ছে। ভালো-বাসায় পৌঁছে দেখি দিদি রয়েছেন তেতলার ঘরে। কোনও একটা লেখা তখনই শেষ করে চোখ বোলাচ্ছিলেন। আমাকে দেখেই বললেন, এসে গেছিস। বোস্। অনেক কাজের কথা আছে। আর তোকে আজ একটা দারুণ জিনিস খাওয়াব। বউমা দুপুরে বানিয়েছিল। আমি বলেছি তোর জন্য রেখে দিতে। গরম গরম ভেজে দেবে....।

শুনেই তো আগ্রহ মোর অধীর অতি....। একটু পরেই নীল রঙের কাজ করা চিনামাটির প্লেটে পরিবেশিত হল সেই সুখাদ্য। সজনে ফুলের বড়া। সজনে ফুলের বোঁটা ছাড়িয়ে, চালের গুঁড়োর সঙ্গে মিশিয়ে ছাঁকা তেলে ভাজা। গোলাতে অবশ্য নুন-মিষ্টি স্বাদমত মেশানো হয়েছে, সঙ্গে একটু ঝালের আভাস। অল্প তিক্ত, অল্প কষায় মুচমুচে সেই বড়া খেতে এককথায় অসাধারণ। আমি বেশ আয়েশ করে সেই বড়া খাওয়ার পর বললাম, দিদি আমরা কিন্তু সজনেফুলের বড়া করি না। আমরা বানাই সজনে ফুলের ঝাল। এটা একেবারে বর্ধমানের নিজস্ব রান্না। সজনে ফুলের এই ঝাল আমার মা রাঁধতেন। ঠাকুমার কাছে শেখা। গাছতলা থেকে কুড়িয়ে আনা বেশ তাজা ফুলের বোঁটা বাদ দিয়ে প্রথমে অল্প একটু নুন দিয়ে হাল্কা ভাপিয়ে জলটা ফেলে দিত মা। তাহলে নাকি কষাভাবটা কমে যায়। অল্প আলু ছোট ছোট করে কেটে রাখত আগে। বাটিতে থাকত কয়েকটা ছাড়ানো মটরশুঁটি, টোম্যাটো কুচি আর অল্প সর্ষে-পোস্ত বাটা। কড়াইয়ে সর্ষের তেলে কাঁচালঙ্কা ফোড়ন দিয়ে প্রথম আলুটা হালকা করে ভেজে নিয়ে ভাপানো ফুলগুলো দিয়ে দিত। খুন্তি দিয়ে একটু উল্টেপাল্টে দিয়ে তারপর টোম্যাটো আর মটরশুঁটি দিয়ে খানিকটা নাড়াচাড়া করেই দিত সর্ষে-পোস্ত বাটা। বাটি ধোয়া জলটুকু দিয়ে, স্বাদমত নুন মিশিয়ে কড়াই ঢাকা দিলেই একটু পরে চমৎকার সজনে ফুলের সুগন্ধ বেরোত। আলু-টোম্যাটো সব নরম হয়ে গেল ওপর থেকে কাঁচা সর্ষের তেল আর চেরা কাঁচা লঙ্কা ছড়িয়ে নামিয়ে নিলেই ঝাল তৈরি। একপদেই ভাত খাওয়া হয়ে যেত আমার।

মায়ের কাছে এই রান্নাটা আমি শিখেছি। আর ঠিক একই ধরনের আর একটা রান্না শিখেছিলাম ডলিদির কাছে। ডলিদি আমার মেয়ের যখন ছয়মাস বয়স তখন তার দেখাশোনার জন্য বহাল হয়ে মেয়ে তেইশ বছরের হয়ে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে গেল তখন কাঁদতে কাঁদতে অবসর নিল। আর শরীরে দিচ্ছিল না। সেই ডলিদি খুব কচি, একদম লতপতে সজনে ডাঁটার ঠিক একইরকম বাটি চচ্চড়ি রেঁধে খাইয়েছিল। সেই রান্নার গল্পটাও ছিল বেশ মজাদার। মেদিনীপুরে ডলিদির শ্বশুরবাড়িতে মস্ত একখান পুকুর ছিল। তার চারধারে সজনে গাছে। সর্ষে-পোস্ত বেটে রেখে পুকুরে স্নান করতে যেত ডলিদির বড় জা। গাছ থেকে পুকুরের জলে খসে পড়ত সেই কচি লতপতে সজনে ডাঁটা। তিনি দিব্যি গামছা ছাঁকা দিয়ে সেগুলি তুলে এনে ভেজা কাপড়েই কেটে-কুটে, সর্ষে-পোস্ত মাখিয়ে, তেল-লঙ্কা ছড়িয়ে উনুনের নিভু আঁচে বসিয়ে কাপড় ছাড়তে যেতেন। ফিরে এসে ভাত বাড়তে বাড়তে বাটি-চচ্চড়ি তৈরি। ব্যাস্ এরপর দু-জায়ে মিলে ভাতের হাঁডি আর সেই চচ্চড়ির বাটি নিয়ে বসে পড়লেই হল।

সজনে ফুলের ইদানীং খুব সুনাম হয়েছে। তার পাতা, ফুল, ডাঁটা সবই নাকি দারুণ উপকারী। সজনে পাতার গুঁড়ো মোরিঙ্গা পাউডার বলে প্যাকেটে করে বিক্রি হয়। খেতে মোটেই সুস্বাদু নয়। তবু ঘি কিংবা ডালের সঙ্গে মেখে খান অনেকেই। আমাদের ছোটবেলায় অবশ্য এত উপকারের কথা জানা ছিল না। কিন্তু গুণের কথা না জানলেও স্বাদটি ছিল খুব পছন্দের। সজনে ফুল কিংবা ডাঁটা অবশ্য তখন বাজারে কিনতে পাওয়া যেত না। বাড়ির গাছেই এত হতো যে লোকে নিশ্চিন্তে পাড়া-প্রতিবেশীকে বিলিয়ে দিত। সেই রাম-রাজত্ব অবশ্য এখন আর নেই। ফাগুন মাস পড়লেই সোনার দামে বাজার থেকে সজনে ফুল কিনেত হয়। কিন্তু তাও লোভ সামলানো যায় না। কিনে আনি ফুল আর ডাঁটা দুই-এরই ঝাল কিংবা বাটি চচ্চড়িও রেঁধে ফেলি। নবনীতাদির বাড়িতে বড়া খাওয়ার কিছুদিন পরে ওঁর জন্যও রেঁধে নিয়ে গেছিলাম। আমি কোনওদিনই তেমন পোক্ত রাঁধুনি নই। কিন্তু সেদিন দিদি খুব খুশি হয়ে আমার রাঁধা সজনে ফুলের ঝাল খেয়েছিলেন।