
দীর্ঘদিন সাংবাদিকতা করার কারণে বিভিন্ন জগতের সেলিব্রিটিদের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ হয়েছে। তাঁদের আচার-আচরণ, মানসিকতা সম্পর্কে একটা ধারণাও তৈরি হয়েছে। যেমন একটা কথা বলাই যায় এই সব ধরনের সেলিব্রিটিরাই নিজেদের ইমেজ সম্বন্ধে যথেষ্ট সচেতন। ঠিক কতটুকু বলা দরকার, তার বেশি বলা কিংবা হাসা হয়ে গেল কিনা সেবিষয়ে সতর্ক থাকেন। কোন দরের মানুষের সঙ্গে কেমনভাবে কথা বলবেন, সেটাও দিব্যি নির্দিষ্ট করা থাকে। আরও একটা সাংঘাতিক ব্যাপার থাকে, সেটা হল মুড। কোনও নায়ক বা নায়িকা যদি একবার বলে বসেন, যে আজ তাঁর মুড অফ্ রয়েছে, তাহলে আমাদের মতো সাংবাদিকদের তো বটেই, অধিকাংশ সময় ইউনিটের লোকজনেরও মাথায় হাত পড়ে যায়। তবে এটাও ঠিক যে এই মুড নিয়ে মাথাব্যাথাটা বলিউড কিংবা টলিউডের লোকজনের বেশি। শুধুমাত্র নায়ক-নায়িকা নয়, তার থেকে অনেক নিচের স্তরের অভিনেতারাও মুডের মাথায় চলেন এবং অনেকসময়ই সেই কারণে গাড্ডায় পড়েন। এত কথা বললাম এই কারণে যে আজকে যাঁর সঙ্গে প্রথম আলাপের কথা বলব তিনি নাকি এরকম মুডের জন্য একসময় বলিউডের ত্রাস ছিলেন। অবশ্যই সত্যিমিথ্যা যাচাই করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়, সবটাই শোনা কথা কিংবা পত্র-পত্রিকায় পড়া। আমার আজকের অতিথি রবিনা ট্যান্ডন। মুম্বই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির একসময়ের প্রথম সারির নায়িকা। আমি অবশ্য যে সময়ের কথা বলছি, মানে যখন তাঁর সঙ্গে পরিচিত হলাম ২০০৯ সাল নাগাদ, তখন তিনি ছবিতে অভিনয় করা প্রায় ছেড়েই দিয়েছেন।
রবিনা ট্যান্ডন কলকাতায় এসেছিলেন রাজা সেনের ছবি ল্যাবরেটরিতে অভিনয় করতে। সোহিনীর ভূমিকায় রবিনা। নীলার চরিত্রে অর্পিতা চট্টোপাধ্যায়। আমহার্স্ট স্ট্রিটের লাহা বাড়িতে শ্যুটিং-এর ব্যবস্থা। সেখানে গিয়ে আমি একপ্রস্থ ছবি তুলে অর্পিতার সঙ্গে কথাবার্তা বলে এসেছি। কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই চাইছিলাম রবিনা ট্যান্ডনের একটা আলাদা ইন্টারভিউ। কিন্তু সেদিন সেটা করা গেল না। পরিচালক জানিয়ে দিলেন, ছবিতে সোহিনীর চরিত্রে অভিনয় করছেন রবিনা। বিধবার চরিত্র। তাই পোশাক-মেকআপও সেরকম। সেই পোশাকে ইন্টারভিউ দেবেন না। তাই ঠিক হল দুদিন পরে, যেদিন শ্যুটিং-এর চাপ কম, সেই অবসরে রবিনা আসবেন আমাদের স্টুডিওতে। পরিচালক রাজা সেন আমাকে আগেই সাবধান করে দিলেন যে মুম্বইয়ের নায়িকারা নাকি কলকাতার অভিনেত্রীদের মতো মোটেই মাটির মানুষ নন। তাঁরা ভয়ঙ্কর মেজাজি, মুডি এবং পেশাদারি। সুতরাং সেই বুঝে কথা বলতে হবে। এই পেশাদারি ব্যাপারটা যে কী ধরনের সেটা তার আগে আমি শাবানা আজমি এবং তাব্বুর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বুঝেছি। তাই খানিকটা প্রস্তুতি ছিলই। কিন্তু মেজাজ এবং মুডের মোকাবিলা তখনও করিনি।
দিনক্ষণ সব ঠিক হয়ে গেল। নির্দিষ্ট দিনে স্টুডিও এবং ক্যামেরা রেডি করে আমি অপেক্ষা করছি। পরিচালক এসে গেছেন। কথা আছে রবিনাকে গাড়ি হোটেল থেকে নিয়ে আসবে। কিন্তু সেই গাড়িও আসে না , নায়িকাও আসেন না। প্রায় একঘণ্টা পেরিয়ে যাওয়ার পর পরিচালক সাহসে ভর করে ফোন করলে, তাঁর ম্যানেজার ধরে জানালেন ম্যাডাম বিশেষ কাজে ব্যস্ত আছেন। একটু দেরি হচ্ছে। এবার পৌঁছে যাবেন। আবার প্রায় আধঘণ্টা অপেক্ষা। স্টুডিও আটকে রাখা হয়েছে। এদিকে পরিচালকের সাহস নেই আবার ফোন করার। যদি রেগেমেগে শ্যুটিং ক্যানসেল করে চলে যায়, তাহলে তো তিনি জলে পড়ে যাবেন। বাধ্য হয়েই আমি ফোন করলাম। সেই ম্যানেজারই ফোন ধরলেন। কিন্তু আমি তাঁকে বললাম যে আমি রবিনার সঙ্গেই কথা বলব। বাধ্য হয়েই মহিলা ফোন দিলেন রবিনাকে এবং ফোন ধরামাত্রই নায়িকা প্রায় চিৎকার করে আমাকে জানিয়ে দিলেন যে তাঁকে বিশেষ জরুরি কাজে এয়ারপোর্টে আসতে হয়েছে। এখান থেকে কাজ শেষ না করে তিনি বেরোতে পারবেন না। সুতরাং আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।
ততক্ষণে আমার মাথাও বেশ একটু গরম হয়ে গেছে। তাই আমিও অত্যন্ত ঠাণ্ডা গলায় জানিয়ে দিলাম যে কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে সেটা আমাকে না বলতে পারলে ইন্টারভিউ ক্যানসেল করতে আমি বাধ্য হব। কারণ এভাবে অনন্তকাল স্টুডিও আটকে রাখা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি একজন পেশাদারি সাংবাদিক। আমার অফিসের কাছে আমি দায়বদ্ধ। তাই কারও ইচ্ছে-খুশি মেনে নিয়ে আমি কাজ করতে পারি না। এয়ারপোর্ট যাওয়ার কথাটা তাঁর উচিত ছিল আমাকে আগেই জানানো তাহলে আমি সেই অনুযায়ী বিকল্প ব্যবস্থা করতাম।
কথাগুলো অবশ্য যেভাবে বললাম ঠিক সেরকম ঠাণ্ডাভাবে গুছিয়ে বলা যায়নি। মাঝে-মাঝে রবিনার চিৎকার এবং মন্তব্য ছিল। তবে সেগুলো আমি তখন মোটেই পাত্তা দিচ্ছিলাম না। পরিচালক ফ্যাকাসে মুখে আমার পাশেই বসে ছিলেন। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছিল, যে কোনওসময় অজ্ঞান হয়ে যাবেন। শেষপর্যন্ত আধঘণ্টার মধ্যে রবিনার আসার ব্যাপারে নির্দিষ্ট কোনও তথ্য না পেলে ইন্টারভিউ ক্যানসেল করে দেব জানিয়ে আমি ফোন কেটে দিলাম। ঠিক কুড়ি মিনিটের মাথায় রবিনার ম্যানেজারের ফোন এল। রবিনা এয়ারপোর্ট থেকে রওনা দিয়েছেন। আমি যেন অপেক্ষা করি।

রাস্তায় তেমন কোনও সমস্যা হয়নি। তাই এয়ারপোর্ট থেকে রবিনা ঠিকঠাক এসে পৌঁছলেন। ইন্টারভিউ হওয়ার কথা ছিল দুপুর তিনটেয়। তখন সন্ধে সাতটা। স্বভাবতই আমার মেজাজ খারাপ, মুখ গম্ভীর। স্টুডিওতে অন্য একটা প্রোগ্রাম হচ্ছে। মিনিট দশেক পরে খালি হবে। রবিনা এসে বসলেন অতিথিদের বসার ঘরে। কফি দিতে বলে আমি গেলাম কথা বলতে। যতই বিরক্ত লাগুক ইন্টারভিউয়ের আগে একটু কথা না বলে নিলে কাজ ঠিকঠাক হয় না। রবিনা বসে আছেন সোফায়। একসময় চোখ ধাঁধানো সুন্দরী ছিলেন। বয়সের সঙ্গে জৌলুস কমে গেছে। তাও কোনওরকম সাজগোজ, মেক-আপ ছাড়াও অপূর্ব। আমাকে দেখে বললেন,
আপনিই, দীপান্বিতা, আমাকে ফোন করেছিলেন ?
মাথা নেড়ে পাশের সোফায় গিয়ে বসলাম। রবিনা আমার দিকে ঘুরে হাত বাড়িয়ে আমার দুহাত চেপে ধরে বললেন,
স্যরি, আমি খুবই দুঃখিত। আপনার সঙ্গে অত্যন্ত খারাপ ব্যবহার করেছি। করাটা ঠিক হয়নি। করতে চাইওনি। কিন্তু তখন আসলে আমার মাথার ঠিক ছিল না। কারণটা আপনাকে বলি। আমার ছেলের বয়স চারবছর। তাকে আমি মুম্বইয়ে ওর বাবার কাছে রেখে এসেছিলাম। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে এখন তো আর আমি নিয়মিত ছবিতে কাজ করি না। তাই বাইরে কোথাও যেতেও হয় না। ছেলে আমাকে ছেড়ে থাকতে অভ্যস্ত নয়। তাই এই চারদিন ক্রমাগত কেঁদে তার জ্বর এসে গেছে। এদিকে আমার স্বামী এত ব্যস্ত যে ওকে যে নিয়ে আসবে তার সময় নেই। তাই বাধ্য হয়ে আমাদের একজন কাজের লোককে দিয়ে ছেলেকে আমার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে। আমি এয়ারপোর্টে গেছিলাম ছেলেকে আনতে। প্লেন লেট করেছে। লাগেজ আসতে দেরি করছে। সবমিলিয়ে আমার তখন পাগলের মতো অবস্থা। তাই তখন আপনাকে যে কী বলেছি আমি নিজেও জানি না। শেষকালে ছেলে ছুটতে ছুটতে গেট দিয়ে বেরিয়ে এসে কোলে উঠতে আমার মাথাটা ঠাণ্ডা হল, আমি ম্যানেজারকে বললাম, এক্ষুণি ফোন করে বলো আমি যাচ্ছি। স্যরি দীপান্বিতা আসলে ওকে না দেখা পর্যন্ত আমি কিছুতেই.......
আমার মেয়ে তখন বছর ছয়েকের। রবিনার মানসিক অবস্থাটা যে ঠিক কী ছিল সেটা বুঝতে আমার একটুও অসুবিধা হয়নি। তারপর একটা চমৎকার ইন্টারভিউ হয়েছিল, গল্পও হয়েছিল অনেক। সেসব কথা বিস্তারে পরে বলা যাবে। তবে বলিউডি তারকা একদম মাটির মানুষ হয়ে গল্প করেছিলেন। ছেলের জন্য কিনে দেওয়া চকোলেট খুশি হয়ে নিয়েছিলেন। আমারও একটা সাংঘাতিক শিক্ষা হয়েছিল। তারকাদের মেজাজ বা মুডের ব্যাপারটা যে সবসময় সাজানো নয়, তার পিছনে সত্যিই কোনও গুরুত্বপূর্ণ কারণ থাকতে পারে, সেটা বুঝেছিলাম সেদিন।