
এবার বর্ষা বেশ ঘনঘোর করে নেমেছে। ঘুম ভাঙছে মেঘের গুরুগুরু আওয়াজে। তারপর সারাদিন ঝমঝম কিংবা ঝুপঝুপ কিংবা ঝিমঝিম। গাছাপালা সব নেয়ে-ধুয়ে ফিটফাট। কাদা মাটিতে ফনফনিয়ে বাড়ছে আগাছার জঙ্গল। এসব কারণে অনেকেরই বর্ষা ভারি অপছন্দ। তারা মনে করে, আকাশের মেঘগুলোকে কাঁচি দিয়ে কেটে গ্রামে-গঞ্জে ছেড়ে দিয়ে আসতে পারলে ভালো হয়। সেখানে যতখুশি জল ঝরুক। শহর যেন শুকনো খটখটে-ফিটফাট থাকে। প্রকৃতি অবশ্য এমন মামাবাড়ির আবদারে কান দেন না মোটেই। তাই তিলোত্তমাতেও বৃষ্টি নামে অঝোরধারে।
আমার অবশ্য চিরকালই বর্ষা খুব পছন্দ। আসলে আমার ছোটবেলা যেখানে কেটেছে সেই রাঢ়বাংলায় বর্ষা ছিল বড় আদরের। দীর্ঘ দারুণ দহনজ্বালাময় গ্রীষ্মের পর আমরা আকুলভাবে অপেক্ষা করতাম আকাশে জমে ওটা কালো মেঘের জন্য। নাকভরে নিতাম প্রথম বৃষ্টির পর ভেজা মাটির সুবাস। সেই মোহ এখনও কাটেনি। বৃষ্টি আমার ভালো লাগে। বৃষ্টিতে ভিজতেও ভালো লাগে। আজ তাই এই বর্ষার দিনে বৃষ্টিতে ভেজার গল্পই শোনাই।
স্কুলজীবনে আমার ঘনিষ্ঠতম বন্ধু ছিল রীনা দত্ত। আমরা কাছাকাছি থাকতাম। স্কুলে ঝগড়া করে আড়ি হলে বিকেলে বাড়ি ফেরার পর ভাব হয়ে যেত। আমাদের বাড়ি থেকে স্কুল ছিল বেশ খানিকটা দূরে। তাই স্কুলবাসে চেপেই যাতায়াত করা হত। তখন আমরা বোধহয় অষ্টম শ্রেণি। এরকমই এক বর্ষার দিনে কী কারণে এখন আর মনে নেই বেশ খানিকক্ষণ আগে স্কুল ছুটি হয়ে গেছিল। বাস আসতে দেরি আছে। তাই আমি আর রীনা ঠিক করে ফেললাম বাসের জন্য অপেক্ষা করার দরকার নেই। আমরা বাড়ি চলে যাব। রাধানগর মোড় নামে একটা জায়গা ছিল যেখান থেকে বাড়ি যাওয়ার জন্য রিকশা পাওয়া যেত। সেই জায়গাটাও স্কুলের খুব কাছে নয়। বাসে করে যাওয়া যায়। কিন্তু মফঃস্বল শহরে বাস তো আর অত সুলভ নয়, তাই আমরা ঠিক করলাম শর্টকাট রাস্তা দিয়ে ওই রাধানগর মোড় পর্যন্ত হেঁটেই চলে যাব।
যেমন ভাবা তেমনি কাজ। বেরিয়ে পড়লাম দুজনে। এবার এই রাধানগর মোড় পর্যন্ত শর্টকাট রাস্তাটা কীরকম সেটা একটু বলে নেওয়া দরকার। আমাদের স্কুল থেকে বেরিয়ে একটু এগোলে রেললাইন পার হতে হয়। তারপর পায়ে চলা পথ ধরে কয়েকটা সরকারি কোয়ার্টার পেরিয়ে, আসানসোল কোর্ট আর গঙ্গার হোটেলের পিছন দিয়ে গোটাকতক শুকনো নালা ডিঙিয়ে খানিকটা গেলে পিচ রাস্তায় ওঠা। রাস্তার সামনে শেষ দেখা যায় না এমন একখানা বড় মাঠ। একসময় পোলো খেলা হত বলে তার নাম পোলো গ্রাউন্ড। ইন্দিরা গাঁধী, জ্যোতি বসুর মতো নেতা এলে ওই মাঠে বক্তৃতার ব্যবস্থা হত।
তবে সামনে মাঠ হলেও ওই পিচ রাস্তাটা কিন্তু ডানদিকে সোজা গিয়ে একেবারে জেলখানা পেরিয়ে জিটি রোডে মিশেছে। আর বাঁদিকটা এগিয়েছে দুধারে বড় বড় গাছের সারির মধ্যে দিয়ে। রাস্তার ওই বাঁদিকের অংশটায় ছিল সব আমলাদের বাংলো। আমাদের প্রাক্তন মুখ্য সচিব প্রসাদরঞ্জন রায় যাঁকে আমরা রাজাদা বলে ডাকি তাঁর কাছে গল্প শুনেছি, তিনিও অল্পবয়সে আসানসোলের জেলাশাসক থাকাকালীন ওই বাংলোতে থাকেন। বাংলো পেরিয়ে মেয়েদের কলেজ। বিকেলবেলায় মেয়েরা যখন দলবেঁধে কলকল করে গল্প করতে করতে বাড়ি ফিরত, তখন নাকি সদ্য বিবাহিত বউদির বাড়ির জন্য খুব মনকেমন করত।
আমি আর রীনা যখন ওই পিচ রাস্তায় গিয়ে উঠলাম তখন আকাশের ঘন কালো মেঘ প্রায় মাটির কাছাকাছি নেমে এসেছে। যে কোনও সময় বৃষ্টি নামবে। একটু অপেক্ষা করা কিংবা গাছের নিচ দিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়াই ঠিক ছিল। কিন্তু আমরা তখন অষ্টম শ্রেণি, আমরা তখন তেরো। তাই ঠিক করে ফেললাম আমরা মাঠ দিয়ে হেঁটে যাব। মাঠের অন্যপ্রান্তে রাধানগর মোড়, সেখান থেকে আমাদের রিকশা ধরা।
দুজনে মিলে হাত ধরাধরি করে যাত্রা শুরু করে দিলাম। খানিকটা এগোতে না এগোতেই বৃষ্টি নামল একেবারে মুষলধারে। আমাদের তখন ফুর্তি দেখে কে !রীনা খুব ভালো গান গাইতে পারত। সে গলা ছেড়ে এস নীপবনে, ঝরঝর মুখর বাদর দিনে গাইছে আর আমি মনের সুখে মাথা দোলাচ্ছি। তারপর যখন, হৃদয় আমার নাচেরে আজি্কে.....গাইতে শুরু করল তখন জীবনে নাচ না শেখা আমিও দুহাত তুলে ঘুরে ঘুরে নাচ জুড়ে দিলাম। দুজনেই ভিজে জুবজুবে। মাথা-মুখ দিয়ে জল ঝরে পড়ছে অঝোরে । স্কুলের জামা ভিজে লেপটে গেছে। জুতো ভিজে একশা। কিন্তু সে যে কী আনন্দ ভাবলে এতদিন পরেও মন চঞ্চল হয়ে ওঠে। গোটা মাঠ ওরকম ঝমঝমে বৃষ্টিতে মনের সুখে ভিজে অবশেষে রাধানগর মোড়ে এসে আমরা রিকশায় উঠলাম। ঝগড়া করতে হল। কারণ রিকশাওলারা আমাদের নিতে চাইছিল না মোটেই। তারপর বাড়ি ফিরে মার খেয়েছিলাম কিনা মনে নেই। তবে জ্বরজারি কিছু হয়নি।
আজ শোনালাম বন্ধুর সঙ্গে বৃষ্টিতে ভেজার গল্প। এরকম বৃষ্টিতে ভেজার রোম্যান্টিক গল্পও কিন্তু আছে। সেটা বলব পরের পর্বে। আর একটা কথা বলে রাখা ভালো, আমার এই লেখা পড়ে কেউ যেন আবার ঘটনাস্থলের সঙ্গে মেলাতে যাবেন না। সেসব বদলে গেছে আমূল। সেই পায়ে চলা রাস্তা, বিশাল পোলো গ্রাউন্ড সেসবের এখন আর কোনও অস্তিত্বই নেই।