এখন যদি কেউ জিজ্ঞাসা করে যে তোমার সবথেকে প্রিয় খাবার কী, তাহলে যে উত্তরটা দেব, সেটা শুনলে অনেকেই অবাক হয়ে যাবেন। কেউ কেউ হয়তো বুঝতেও পারবেন না কারণ নামটা অচেনা। আর বেশিরভাগ মানুষ হেসেও ফেলতে পারেন। কিন্তু কিছু করার নেই। নিজের ব্লগে তো আমাকে সত্যি কথা বলতেই হবে। তাছাড়া সৃষ্টিছাড়া টেস্টি নামেই মালুম দেয় যে এখানে আমি একটু অন্যরকম অপরিচিত খাবারের কথাই লিখব। তাই কথাটা এখানেই সবার সামনে দিল খুলে বলে দেব ঠিক করেছি। যাই হোক্, আর রহস্য করে কাজ নেই, যে খাবারটা আমার এই মুহূর্তে সবথেকে প্রিয়, রোজ ভাতের পাতে না পেলে রীতিমতো মন খারাপ হয়ে যায় সেটা হল খাঁকরি। আমরা মানে এদেশিরা যাদের ঘটি বলা হয়, তারা বলি খাঁকরি আর পূর্ববঙ্গীয়রা বলেন চাঁচি। ব্যাপারটা আর কিছুই নয়, এটা তো সবাই জানি যে মাখন জ্বাল দিয়ে ঘি হয়। এই দুধের ক্রিম বা সর জ্বাল দিয়ে যখন ঘি তৈরি হয়ে গেল, তখন ঘিটা ছেঁকে আলাদা করার পর পাত্রের নিচে বাদামি রঙের অবশেষ পড়ে থাকে। ওই সর বা ঘি-এর যে অবশিষ্টাংশ তাকেই বলে খাঁকরি। গরম ভাতের সঙ্গে সেই ঘি-এর গন্ধওলা খাঁকরি বা চাঁচি খেতে এককথায় অনবদ্য। সুবিধাও একটা আছে। ভাতের পাতে ঘি তো আর রোজ খাওয়া যায় না। ওজন বেড়ে যেতে পারে। আগে কোলেস্টেরল বাড়ার ভয়ও ছিল। যদিও ইদানীং ডাক্তাররা বলছেন সেটা নাকি ঠিক নয়। তবে খাঁকরিটা কিন্তু বেশ নিশ্চিন্তেই খাওয়া যায়, কারণ তাতে ঘি-এর পরিমাণ নেহাতই নগণ্য।

এবার বলি এই খাঁকরির সঙ্গে আমার পরিচয় হল কীভাবে। সে কিন্তু অনেকদিন আগের কথা। আমি তখন শিশুই বলা চলে। সবেমাত্র কিন্ডারগার্টেনে ভর্তি হয়েছি। সম্ভবত স্বাদটা খুব ভালো লেগেছিল বলে ঘটনাটা মনে আছে। আমি ওরকম খুদে। তারমানে আমার মা তখন নেহাতই ছেলেমানুষ। ফলে বাড়িতে ঘি বানানোর কোনও পাট ছিল না। আর খাঁকরিটা যেহেতু নেহাতই ঘি-এর বাই প্রোডাক্ট তাই বাড়িতে না বানালে তো খাওয়া সম্ভব নয়। সেই সময় আমরা থাকতাম বার্নপুর রোড বলে একটা জায়গায়। আমাদের প্রতিবেশী ছিলেন বিশ্বাস জেঠু। একদিন বিকেল নাগাদ মা গেছে জেঠিমার সঙ্গে গপ্প করতে। আমি মায়ের লেজুড়। তখন জেঠুর মেয়ে গৌরীদিদি স্কুল থেকে ফিরে ভাত খেতে বসেছে। জেঠিমা দিদিকে জিজ্ঞাসা করল, খাঁকরি দিয়ে ভাত খাবি ? দিদি মহাখুশি হয়ে মাথা নাড়ল। ফলে আমারও কৌতূহল হল যে জিনিসটা কী ? জেঠিমা আমাকেও আদর করে গুঁড়ো চিনি ছড়িয়ে বাটিতে করে খাঁকরি দিল খেতে । খেয়ে তো আমি মোহিত।

তারপরে বিভিন্ন সময় খাঁকরি খাওয়ার সুযোগ হয়েছে। মামাবাড়ি ছিল গয়লাপাড়া গায়ে। ফলে প্রচুর খাঁটি দুধ। দিদিমা ঘি বানাতেন। মামাবাড়ি গেলে দারুণ খুশি হয়ে জলখাবারে খাঁকরি দিয়ে মুড়ি খেতাম। তারপর একটা সময় গোয়ালার বদলে বোতলে দুধ বিক্রির চল হল। দুধের ডিপোতে দুধ আসতো কাচের বোতলে। কার্ড নিয়ে সেই দুধ আনতে যেতাম। বোতলের মুখে থাকত একদলা মাখন। মা সেই মাখন জমিয়ে ঘি বানাতেন। ফলে আমরাও খাঁকরি খেতাম। কালের নিয়মে সেই দুধ আর মাখন বন্ধ হয়ে বাজারে এল প্যাকেটের দুধ। চালু হয়ে গেল স্কিমড্ মিল্ক। জানা গেল সর কিংবা ননীওলা দুধ খাওয়া নাকি স্বাস্থ্যের পক্ষে ভয়ানক খারাপ। ফলে আমারও খাঁকরির সঙ্গে দীর্ঘ বিচ্ছেদের সূচনা হল। নিজে সংসার শুরু করার পর দু-চারবার ঘি বানিয়েছি, কিন্তু সে নেহাতই বিরল ব্যতিক্রমী ঘটনা।

বিচ্ছেদের অবসান হল অদ্ভুতভাবে। বছর দুয়েক আগে আমার এক বন্ধুর মাধ্যমে পরিচয় অরিত্রার সঙ্গে। সামনাসামনি নয়, ফেসবুকে। পরে অবশ্য সাক্ষাতে পরিচয় এবং বন্ধুত্ব দুই-ই হয়েছে। অরিত্রা এবং তার স্বামী অয়ন, দুজনে মিলে পুনশ্চ কৃষিকাজ নামে একটি খামার চালায়। তাদের উৎপাদিত জিনিসের তালিকায় দেখি লেখা আছে চাঁচি। সন্দেহ হল আমার। অরিত্রাকে ফোন করে জানা গেল চাঁচি ও খাঁকরি হল এক এবং অভিন্ন। দেশের ফেরে নামের বদল। আমি তো মহাখুশি। তখনই অর্ডার করে ফেললাম। সেই থেকে আর কোনও ছাড়াছাড়ি নেই। প্রতিমাসেই পুনশ্চ কৃষিকাজ থেকে খাঁকরি বা চাঁচি আসে আমার বাড়িতে। আমার ঘরের মানুষটি বলেছেন, এত বছরের দীর্ঘ বিবাহিত জীবন এবং তার আগে বেশ লম্বা প্রেমপর্বেও কোনও বিশেষ খাবারের প্রতি আমার এমন অনুরাগ এবং আনুগত্য তিনি নাকি কখনও দেখেননি। তবে এব্যাপারে পুনশ্চ কৃষিকাজের ভূমিকাও কিছু কম নয়। তাদের ঘি-মাখন-চিজ সবই খুব ভালো। খাঁকরিটাও তারা বানায় অপূর্ব। যেটা একেবারে নেহাতই একটা ঘি তৈরির বাই-প্রোডাক্ট, সেটাতে অমন স্বাদ আর টেক্সচার কীভাবে আনে জানি না। ইদানীং তারা আরও একটা জিনিস বানাচ্ছে, সেটা হল নিম চাঁচি। চাঁচির সঙ্গে নিমপাতা শুকনো ভাজা মেশানো। সেটাও এককথায় দারুণ খেতে। অবশ্যই যাঁরা তেতো খেতে বিশেষ করে নিমপাতা খেতে পছন্দ করেন তাঁদের ভালো লাগবে। নিমপাতার একটা নিজস্ব সুগন্ধ আছে, তার সঙ্গে ঘি-এর সুগন্ধ মিলে চমৎকার একটা জিভে জল আনা ব্যাপার হয়। আমার তো হয়, আপনাদেরও হতেই পারে। আমি অনেকসময় অরিত্রাদের খাঁকরির সঙ্গে সজনেপাতার গুঁড়ো মিশিয়ে খাই। সেটাও দিব্যি লাগে। যাঁদের মধুমেহ আছে তাঁদের জন্য খুব উপকারী। আমার যদিও খাওয়ার সময় উপকারের কথা মনে থাকে না মোটেই, জিভের দিকেই বেশি মনোযোগী হয়ে পড়ি। প্রসঙ্গত বলে রাখি, লীলা মজুমদারও কিন্তু তাঁর পাকদণ্ডী উপন্যাসে চিনির গুঁড়ো ছড়িয়ে চাঁচি খাওয়ার কথা বলেছেন।

আমরা বাঙালিরা কোনও জিনিসই ফেলে দেওয়া পছন্দ করি না। আলু কিংবা লাউয়ের খোসা ভাজা খাই। পটল আর কাঁচকলার খোসা বেঁটে খাই। কচুর লতি জুত করে রাঁধি। এসবই কিন্তু ফেলা-ছড়ার জিনিস, ইংরাজিতে যাকে বলে বাই-প্রোডাক্ট। খাঁকরিও তাই। বানাতে খরচা নেই কোনও। কিন্তু ভাতের পাতে পড়লেই স্বাদে-গন্ধে দিলখুশ।